বিশ্ব জগতের রব মহান আল্লাহ যেমন বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন তেমনি তাঁর প্রিয় হাবীব ও সারা বিশ্বের সকলের জন্য রাসুল এবং রহমত। সুরা আরাফ আয়াত-১৫৮ এবং সুরা আম্বিয়া আয়াত নং-১০৭। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার পূর্বের নবীগণ বিশেষ জাতির নিকট প্রেরিত হতেন। আর আমি সকল মানুষের কাছে সার্বজনীন রাসুলরূপে প্রেরিত হয়েছি। (ইবনু কাছীর)।
সুরা আম্বিয়ার উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসুলকে সারা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত বলা হয়েছে এবং এ রহমত ‘হাদীয়া’ হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে। ইমাম বুখারী হাদীসটিকে ‘মুরসাল’ বলেছেন। পক্ষান্তরে ইবনু আনাকির হীদাসটিকে ‘মারফু’ বলেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবনের সবচেয়ে বড় সমাবেশ ছিল বিদায় হজের সমাবেশ। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন যিলক্বদ মাসের পাঁচ দিন পূর্বে শনিবার দিন রাসুল (সা) এবং সাহাবীগণ মদিনা হতে রওয়ানা দেন। বুখারী শরীফ ইবনু হাজার আসকালানী (রহ) চার দিন পূর্বে রওয়ানার কথা উল্লেখ করেছেন।
আবু দুজানা সাঈদী (রা)কে মদীনার অস্থায়ী শাসক নিযুক্ত করে যান। (ইবনু হিশাম)। কারও মতে সিবা ইবনু উরফুতা গিফারী (রা:) কে মদীনার অস্থায়ী শাসক নিযুক্ত করেন। (আসাহুস সিয়ার)। নবীজীর এই সফরের সঙ্গি সাথী ছিলেন : ১ লক্ষ ২৪ হাজার মতান্তরে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার। (আর রাহীকুল মাখতুম) নবী সহধর্মিগণ সকলেই এই সফরে নবীজীর সফরসঙ্গি হয়েছিলেন।
মদীনা হতে ৬ মাইল দুরে যুল-হুলায়ফাতে ইহরাম বেঁধে তালবিয়া উচ্চস্বরে পাঠ করেন। ৮/৯ দিন কিংবা শনিবার ধরে ৯ দিন আট রাত পর ৪ জিলহজ্জ রবিবার মক্কায় পৌছেন। প্রথমে বায়তুল্লা তাওয়াফ করেন। প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ করেন। এরপর ‘মাকামে ইব্রাহিম’- এর পিছনে (অর্থাৎ পূর্বে) আসেন ২ রাকাত সালাত আদায় করেন। তারপর সাফা-মারওয়া সাঈ করেন। সাহাবীদেক নির্দেশ দিলেন যাদের সাথে কুরবানির পশু নেই তারা ওমরা করে হালাল হয়ে যাও।
এমনকি নবী সহধর্মিগণ ও হালাল হয়ে গেলেন। উম্মুল মুমিনিন হাফসা (রা) বলেন আমি প্রশ্ন করলাম : আপনাকে হালাল হতে কিসে বারণ করলো ? জবাবে নবীজী বললেন, আমি কুরবানীর উটের গলায় তাকলীদ করেছি। তাই নহর (অর্থাৎ কুরবানী) করার পূর্বে আমি হালাল হতে পারবো না। (সহীহ মুসলিম)। এরপর তিনি মক্কা হাজ্জন নামক স্থানে অবস্থান করেন। হজ্জের তাওয়াফ ছাড়া আর কোন তাওয়াফ করেননি। (বুখারী শরীফ)। রবি, সোম, মঙ্গল ও বুধ ৪ দিন পর ৮ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার সকাল সকাল মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
বৃহস্পতিবার যোহর থেকে পর দিন ফযর সহ ৫ ওয়াক্ত সালাত মিনায় আদায় করে ৯ই যিলহজ্জ শুক্রবার বেলা উঠার পর আরাফার দিকে রওয়ানা হন। আরাফা অর্থ পরিচিতি অন্য অর্থ সুগন্ধি বাবা আদম (আ) ও মা হাওয়া বেহেস্ত থেকে পৃথিবীতে এসে এখানে পুন: পরিচিতি হয় বলে এই স্থানকে আরাফা বলা হয়। অন্য অর্থে কুরবানির রক্তের গন্ধে মিনার হাওয়া দুর্গন্ধময় হলেও আরাফার হাওয়া দুর্গন্ধ মুক্ত বা সুগন্ধি যুক্ত থাকে এ জন্য আরাফা বলা হয়। সূর্য ঢলে পড়লে কাসওয়া উটের পিঠে আরাফার মাঝামাঝি স্থানে গমন করেন। উঠের পিঠে সাওয়ারী অবস্থায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার মতান্তরে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার হাজী সাহেবদের বিশ্ব সম্মেলনে বিশ্ব নবী (সা) এক চিরন্তন নীতি নির্ধারণীমূলক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।
তিনি বলেন, ‘হে লোক সকল আমার কথা শোনো, আমি জানি না এবারের পর তোমাদের সাথে এ জায়গায় মিলিত হতে পারবো কিনা। তাঁর বক্তব্য উচ্চস্বরে জনতার মাঝে শুনাচ্ছিলেন যিনি তার নাম: রবীথা ইবনু উমাইয়া ইবনু খালফ। (ইবনু ইসহাক) ইসলামের বিধান সমূহকে সুসংহত ও সুনির্ধারিত করে কুফর ও জাহিলিয়াতের মানব রচিত বিধি-বিধানকে চুরমার করে দেন। জানমাল ও ইজ্জতের হুরমতের ঘোষণা দেন। যা সকল জাতির নিকট স্বীকৃত।
ভাষণের শেষে নাজিল হলো সুরা মায়েদার ৩নং আয়াতের অংশ বিশেষ যার অর্থ: ‘‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম’’। ওমর (রা) এ আয়াত শুনে কাঁদতে লাগলেন তাকে কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আমরা এই দ্বীন সম্পর্কে আরো বেশি আশা করছিলাম। কিন্তু যখন উহা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করলো তারপর এর চেয়ে বেশি আশা করা যায় না। বরং ক্রমান্বয়ে এর অবনতি আশা করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা) তখন বললেন তুমি ঠিকই বলছো। (তাবারী)। ইবনু মার দুবিয়া হযরত আলী থেকে বর্ণনা করেন যে, এই আয়াতটি নবীজীর দন্ডায়মান অবস্থায় বিকালে আরাফায় নাজিল হয়েছিল। অন্য রিওয়ায়াতে সোমবার উক্ত আয়াত নাজিলের দিন বলা হয়েছে কিন্তু হাদীসটি গরীব ও দুর্বল। (তাবারানী)।
আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন এই আয়াত ‘গাদীরে খুম’ এর দিন নাজিল হয়েছিল। মদিনা আসার পথে। আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত ওই দিনটি ছিল ১৮ জিলহজ্জ মক্কা হতে প্রত্যাবর্তনের দিন। তবে আরাফায় শুক্রবার দিনে নাযিল হওয়া প্রসিদ্ধ মত। বিশ্ব সেরা তাফসীর তাবারীর লেখক ইবনু জারির ও এমত গ্রহণ করেছেন। অন্য বর্ণনায় এ সুরা মক্কা বিজয়ের দিন নাজিল হয়। আস বাবুন নজ্জল, সুফী মুছান্নাফে আরাফার ময়দান থেকে বেলা ডুবার পর মুযদালিফার দিকে রওয়ানা হন।
সারারাত সেখানে অবস্থান করেন। বাদ ফজর সূর্য উঠার আগেই সেখান থেকে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ১০ যিলহজ্জ শনিবার প্রথমে বড় শয়তান জামরায়ে কুবরা সেখানে তখন ১টি গাছ ছিল। জামরায়ে আকাবা বা জামরায়ে উলাও বলা হয়। সেখানে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করেন। প্রতিবার তাকবীর ধ্বনি দিচ্ছিলেন। এরপর কুরবানীর স্থানে গিয়ে নিজ হাতে ৬৩টি উট জবাই করেন।
অবশিষ্ট ৩৭টি উট আলী (রা) কে জবাই করতে দেয়া হয়। তার আদেশে প্রতিটি কুরবানি থেকে এক টুকরা গোশত একটি হাঁড়িতে পাক করা হয়। এরপর মক্কায় গিয়ে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করে মিনায় ফিরে আসে। ওই দিন মিনাতেও সকালে বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্য আলী (রা) সমবেত সাহাবীদেক শোনাচ্ছিলেন। (আবু দাউদ)।
১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্জ মিনায় অবস্থান করেন। মিনায় ১১ যিলহজ্জ রবিবার ইয়াওমুররুস বা আইয়ামে তাশরিকের মধ্যবর্তী দিন ওই দিন কুরআনের সর্বশেষ সুরা ইযাজা আ নাসরুল্লাহ নাজিল হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর থেকে বর্ণিত। (বাইহাকী) ইমাম আহমদ ইবনু আব্বাস হতে বর্ণনা করেন যে, এ সুরা নাজিল হলে রাসুল (সা) বললেন ‘‘আমার কাছে মৃত্যুর পরোয়ানা এসে গেছে’’।
অন্য বর্ণনায় আসছে এরপর থেকে রাসুল (সা) কোমর বেঁধে উঠে পড়ে আখিরাতের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। (ইবনু কাছীর) ১৩ যিলহজ্জ মঙ্গলবার বাদ যোহর মিনা ত্যাগ করেন। আবতাহ উপত্যকায় খায়েকে বাণী কেনানায় অবস্থান করেন। রাতে কাবাঘর তাওয়াফ করে বিদায়ী তাওয়াফ করেন। এভাবেই তিনি বিদায় হজ্জের কার্যক্রম সম্পাদন করেন। বিদায় হজ্জের পরবর্তীতে রাসুলুল্লাহ (সা) এর চিন্তা-চেতনা, অনুভব-অনুভূতি, বাহ্যিক আচার আচরণ ও কথাবার্তায় এমন সব নিদর্শন প্রকাশ পেতে লাগলো, যা থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল যে, তিনি অচিরেই ইহকাল ত্যাগ করবেন। মহান আল্লাহ তার সীরাত থেকে আমাদেক শিক্ষা গ্রহণের তাওফিক দিন। আমীন।
লেখক: মুহাদ্দিস, উম্মুল কুরান কওমি মাদ্রাসা
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | |||||
৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ |
১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ |
১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ |
২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ |
আইটি সাপোর্ট ও ম্যানেজমেন্টঃ Creators IT Bangladesh