কার্তিক মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে। মাস আলাদা হলেও এখনো চলছে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষ। যে শুক্ল পক্ষকে বলা হয় “দেবীপক্ষ”। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া। এই দিন হিন্দুরা তর্পণ করে তাঁদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন।
দেবীপক্ষে যখন চলছিলো দেবী দূর্গার অকালবোধন বা অসময়ে আগমনের প্রস্তুতি, ঠিক তার আগ মূহুর্তে শুক্লা পক্ষের চতুর্থ তিথিতে প্রস্থান করলেন সূর সংগীতে দেবী অন্নপূর্ণা।
চারদিন আগে যেহেতু ছিলো মহালয়া, এ দিনে কী হিন্দু রীতি মেনে বিদুষী অন্নপূর্ণা দেবী করেছিলেন তার পিতা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র তর্পণ বা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান?
নাকি সংগীত সাধনার মতই নৈঃশব্দের ছিলো এ তর্পণ, যা তিনি করে গেছেন পিতার মৃত্যুরও ২০ বছর আগে থেকে?
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র মেজ মেয়ে ছিলো জাহানারা। ঢাকার এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে কন্যাকে বিয়ে দিয়েছিলেন এ সংগীত সাধক। কিন্তু কয়েক বছর পরে শশুড়বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে মাইহারে (মধ্যপ্রদেশ, ভারত) বাবার বাড়ি ফিরে যায় জাহানারা। অপরাধ সে পিতার শেখানো ভজন গেয়েছিলো, এক মুসলিম পরিবার তা মানবে কেন?
অসুস্থ জাহানারা কিছুদিন পর মারা যায়। শোকাহত এক সংগীত সাধক তখনই স্থির করেছিলেন ছোট মেয়ে রওশন আরাকে তিনি সংগীত শেখাবেন না।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর নিয়তি লিখে রাখে আরেক। একদিন সন্তান আলি আকবরকে একটা জটিল সুর তুলতে দিয়ে বাহিরে গেলেন পিতা আলাউদ্দিন খাঁ। বেখেয়ালী আলি আকবর তুলছিলো ভুলভাল সুর। রওশন আরা এগিয়ে এসে বললেন- ” দাদা, তুমি ভুল বাজাচ্ছো”।
তারপর নিজেই বাজানো শুরু করে দিলেন। ততক্ষণে বাবা ফিরে এসে দরজায় দাড়িয়ে দেখলেন কন্যার সংগীত জ্ঞান। তিনি আশ্চর্য হলেন, হলেন মুগ্ধও, আর তাই নিজ প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে দেয়া শুরু করলেন কন্যাকে সংগীতের তালিম।
এবং এ কথা সর্বজনবিদিত যে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র সেরা শিষ্য ছিলেন তার এই মেয়ে। এটা যে শুধু সংগীত অনুরাগে তা নয়, শুধু সংগীত সাধনায় নয়, এটা হৃদয়ের পবিত্রতাতেও।
সংগীতের সাথে অনুরাগ ও সাধনার সমান্তরালে হৃদয়ের পবিত্রতার বিষয়ে অনেকে বিষ্মিত হতে পারেন। যে বিষ্ময় জেগেছিলো রওশন আরার মনেও, একদিন পিতা তার কাছে জানতে চাইলেন সুরবাহারে তালিম নেওয়ার আগ্রহ আছে কি না? এটি সেতারের সমগোত্রীয় সুরযন্ত্র। কিন্তু আকারে আরও খানিকটা বড়, আর বাজানোও বেশ কঠিন। তবে শিখতে পারলে সেটা খুবই গৌরবের ব্যাপার।
আলাউদ্দিন খাঁ তার মেয়েকে বললেন, “তোমাকে আমার গুরুর বিদ্যা শেখাব। কারণ তোমার মধ্যে লোভ নেই। এ বিদ্যা শিখতে হলে খুব শান্ত মন আর অসীম ধৈর্য দরকার। আমার মনে হয়েছে, গুরুর এই উপহার তুমি ধরে রাখতে পারবে। সংগীতের প্রতি তোমার সত্যিকারের অনুরাগ আছে। সেতার সকলেরই পছন্দ, সাধারণ মানুষ ও সমঝদার সবাই সেতার ভালোবাসে।
কিন্তু সুরবাহারের প্রশংসা করবেন কেবল সেইসব শ্রোতা যাঁরা সংগীতের গভীরতা বুঝতে পারেন বা অন্তরের মধ্যে সুর অনুভব করেন। সাধারণ শ্রোতারা অবশ্য তোমার দিকে টমেটো ছুঁড়ে মারতে পারে। এখন তুমি কী করতে চাও সেটা বলো।”
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রওশন আরা সেদিন বলেছিলো- আপনি যা আদেশ করবেন তাই হবে।
সেই একই কথা রওশন আরা তার বাবাকে আরেকবার বলেছিলো, যখন পারিবারিকভাবে নিজ পিতার শিষ্য হিসাবে সহপাঠী রবীন্দ্রশঙ্কর (১৯৪০ সালের দিকে তিনি নাম বদলে রাখেন রবিশঙ্কর) এর সাথে তার বিয়ের কথা বলা হয়।
আলাউদ্দিন খাঁ মেঝ মেয়ে জাহানারার করুন পরিনতি ভেবে সংগীত প্রতিভা রওশন আরার জন্য মুসলিম পরিবার নিরাপদ মনে করলেন না। উপরন্তু তিনি মেয়ের জন্য এমন ছেলেকে পছন্দ করলেন সংগীতের প্রতি যার রয়েছে অপূর্ব নিষ্ঠা।
কিন্তু নিয়তি অন্যকিছুই লিখে রেখেছিলো। বিয়ের পরে স্বামীর ধর্ম গ্রহন করে রওশন আরা হয়ে গেলো অন্নপূর্ণা। তারপর দুজনে একই মঞ্চে একসাথে ডুয়েট বাজাতো। কিন্তু শ্রোতা এবং সমালোচকদের কাছ থেকে অন্নপূর্ণার বেশী প্রশংসা পাওয়াটা রবিশঙ্করের ভালো লাগত না। সেটার একটা বিরূপ প্রভাব পরতো পড়তো পরিবারে রবিশংকরের আচরনে। স্ত্রী গুন ঈর্ষায় সংকির্ণতায় ভোগা এক স্বামী আচরনে সবসময় বুঝিয়ে দিতো উনার বিরক্তি।
সুখী বিবাহিত জীবন, না শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ? অন্নপূর্ণা প্রথমটিই বেছেছিলেন। স্বামীর প্রতিষ্ঠা সুখের জন্য আর কখনো জনসম্মুখে বাজাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু এত বড় আত্মত্যাগের পরও টেকেনি তার সংসার কারন রবিশঙ্করের জীবনে আসে অন্য নারী।
বিবাহ বিচ্ছেদের পরও নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে গেছেন অন্নপূর্ণা দেবী। এ উপমহাদেশে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাবার কথা আসলেই মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের কথা আসে। কিন্তু এ উপমহাদেশে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাবার বড় উদাহরন হওয়া উচিত বিদুষী অন্নপূর্ণা দেবী। যার লোকচক্ষুর অন্তরালে যাবার পেছনের গল্পটা ভালোবাসা আর পরিবারকে রক্ষা করার মহৎ এক আত্মত্যাগের কাহিনী। বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি ফিরতে পারতেন কিন্তু ফেরেননি নিজ প্রতিজ্ঞা রক্ষার দৃঢ়তায়।
লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেও তিনি কিন্তু সংগীত ছাড়েননি। অন্নপূর্ণার আশে পাশে যখন কেউ থাকতো না তখন তিনি বসতেন সুরবাহার নিয়ে। এমনকি তিনি যখন তার শিষ্যদের তালিম দিতেন তখনও বাজিয়ে শোনাতো না, সুরটা গেয়ে শোনাতেন।
নিভৃতে চলে যাবার পর উনার বাদন শোনার একমাত্র সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন জর্জ হ্যারিসন। সত্তরের দশকে বেহালাবাদক মেনুহিনকে নিয়ে ভারত সফরে এসেছিলেন জর্জ হ্যারিসন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের সম্মানে কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মেনুহিন বলেন, তাঁর একটি অসম্ভব আবদার আছে, তিনি অন্নপূর্ণার বাদন শুনতে চান। শ্রীমতী গান্ধী কি সে ব্যবস্থা করতে পারবেন? শ্রীমতী গান্ধীর অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর নিমরাজি হলেন অন্নপূর্ণা। তবে কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে না। তিনি যখন রেওয়াজ করবেন, তখন তাঁরা পাশে বসে তা শোনার সুযোগ পাবেন। নির্ধারিত দিনে মেনুহিন যেতে পারেননি। একমাত্র সৌভাগ্যবান ব্যক্তি হিসেবে হ্যারিসন তাঁর বাদন শোনেন।
এর কয়েক বছর আগে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর অন্যতম আয়োজক ছিলেন জর্জ হ্যারিসন। বাংলাদেশের জন্য তার এই অবদানই কী ঐশ্বরিক পুরষ্কারে তাকে এনে দিয়েছিলো এ সুযোগ? কারন অন্নপূর্ণা দেবীর সুর ঐশ্বর্য তো পিতৃপুরুষের ভূমি হিসাবে এ মাটিরই উর্বরতা।
যাই হোক, গতকালকে বিসর্জন হয়েছে দেবী দূর্গা, আবার গতকালকেই সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে ‘দেবী’ নামের এক সিনেমা।
শেষ খবর যতটুকু শুনেছি, সিনেমা দেবী ভালো চলছে। কিন্তু এত এত বছর পরেও পরিবারের রক্ষনশীলতায় বিসর্জন হয়না জাহানারা কিংবা পুরুষের ঈর্ষায় অন্নপূর্ণার মত দেবীরা?
সে খবর কেইবা রাখে?
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ||||||
২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ |
৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ |
১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ |
২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ |
৩০ | ৩১ |
আইটি সাপোর্ট ও ম্যানেজমেন্টঃ Creators IT Bangladesh