সত্তরের দশকে শুরু করেন সাংবাদিকতা। সেই সময়েই যোগ দেন সরকারি চাকুরীতে। আশির দশকে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হন। সাংবাদিকতা, স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও মুক্ত নাটক এই তিন ফরম্যাটেই লক্ষ্য করা গেছে তার মুন্সিয়ানা। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে রাজনৈতিক কারণে জেলও খেটেছেন তিনি। বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার মেলবন্ধনে অনন্য এই মানুষটির নাম আব্দুল মান্নান পলাশ। সব পরিচয় ছাপিয়ে সাংবাদিক পরিচয়েই তিনি সবার কাছে বেশি পরিচিত। প্রয়াত চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের সান্নিধ্য পাওয়া ও তার লেখার ধাঁচে মোনাজাত উদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রাম, মাটি ও মানুষকে নিয়ে লেখার জন্য তাকে চলনবিল অঞ্চলের চারণ সাংবাদিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। চাটমোহরসহ চলনবিলাঞ্চলের কেউ তাকে মান্নান, কেউ পলাশ নামে ডাকেন। ১০ জুলাই তার ৬১তম জন্মদিন। দীর্ঘ চার দশক সাংবাদিকতায় কাটিয়ে দেয়া মানুষটির জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সাংবাদিকতা, চাকুরী, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আব্দুল মান্নান পলাশ : ১৯৫৯ সালের ১০ জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মরহুম এরাজ উদ্দিন মিয়া, মায়ের নাম মৃত মুসলিমা বেগম। চাটমোহর পৌর সদরের বালুচর মহল্লায় ‘গোধুলিয়া’ নামের বাড়িতে বসবাস করছেন তিনি। তার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে পাবনা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিবৃতি দিয়ে। এ সময় সরকারি চাকুরীতেও ঢোকেন তিনি। ৭৮ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বার্তাবাহক পদে যোগ দেন। পদোন্নতি পেলেন ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর স্টোরকিপার হিসেবে। বিবৃতিতে কাজ করা অবস্থায় ১৯৮০ সালের দিকে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সংযুক্ত হন। চাটমোহরে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শুরু করেন অনেকের সাথে। গঠন করেন চাটমোহর সাংস্কৃতিক পরিষদ। প্রয়াত আব্দুল হামিদ সরকার, এস এম হাবিবুর রহমান, আসাদুজ্জামান দুলাল, জাহিদ, প্রয়াত মতিন, সজল বিশ্বাস, বৃন্দাবন দাশ, শাহনাজ খুশি, রাজিউর রহমান রুমী, ফারুক হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সেলিম, জহুরুল ইসলাম মিন্টু, এস এম আলী আহম্মেদ, রঞ্জন ভট্টাচার্য, শাহিন চৌধুরী সহ অনেকেই ছিলেন। ওই সময় গণসংস্কৃতির কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের বাধা আসতে দেখে অনেকে সাংবাদিকতা করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় রুমী, দুলাল, সজল, হাবিবুর, পলাশ সহ অনেকে যুক্ত হন সাংবাদিকতায়। সে সময় চাটমোহরে প্রথমদিকে সাংবাদিক বলতে হামিদ মাস্টার, রানা মাস্টার, সন্তোষ চৌধুরী, প্রফেসর মান্নান, নজরুল ইসলাম জড়িত ছিলেন। এ সময় যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূরবী পত্রিকায় চাটমোহর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন মান্না পলাশ। আসাদুজ্জামান দুলাল রংপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক দাবানল, রাজিউর রহমান রুমী খুলনার দৈনিক পূর্বাঞ্চল, রঞ্জন ভট্টাচার্য যশোরের দৈনিক রানার, সজল ঢাকার দৈনিক নব অভিযান, হাবিবুর রহমান ঢাকার দৈনিক ঈশান পত্রিকায় কাজ শুরু করেন।
এরপরও নিজেদের সাংস্কৃতিক কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছিলেন না তারা। তারা ভাবলেন জাতীয় সংগঠনের সাথে সংযুক্ত করা দরকার-এ ভাবনা থেকে বাংলাদেশ মুক্ত নাটক দলের সাথে সম্পৃক্ত হলেন তারা। তখন থেকেই পরিষদের কার্যক্রম মুক্ত নাটকের আন্দোলনে ঝুঁকে পড়েন সবাই। সাংবাদিকতা, স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও মুক্ত নাটক এই তিন ফরম্যাটে তারা সরব ছিলেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় মুক্ত নাটক সম্মেলনে চাটমোহর থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দেন মান্নান পলাশ ও প্রয়াত মতিন। তারই এক পর্যায়ে ১৯৮৭ সালের শুরুর দিকে বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক করতোয়া ও একই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় চাটমোহর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন পলাশ। সেখানে কাজ করা অবস্থায় একই বছরে রাজনৈতিক কারণে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার হন পলাশ। এক মাস আট দিন কারাগারে ছিলেন তিনি। ওই সময় জাসদের লতিফ মির্জা, কবির হোসেন, আটঘরিয়ার আনোয়ার হোসেন, ছাত্র মৈত্রীর অ্যাড. শাহিন, অ্যাড. শাহ আলম, ড্যানিস, শ্রমিকলীগ নেতা সরদার মিঠু, খাজা সাত্তার, সমতার নির্বাহী পরিচালক আব্দুল কাদের ও তার সাত ভাই সহ ২৭ জন একসাথে কারাগারে ছিলেন।
জেল থেকে বেরিয়ে এসে সরকারী চাকুরীতে (বিএডিসি) যোগ দেন। ১৯৮৮ সালের কোনো এক সময় দৈনিক আজাদ বন্ধ হয়ে গেলে তখন তার সহকর্মী মিলন রহমান (বগুড়া) এর মাধ্যমে ঢাকা থেকে সদ্য প্রকাশিত দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রথমে চাটমোহর প্রতিনিধি এবং ৩ বছর পরে একই পত্রিকায় চলনবিল প্রতিনিধি হিসেবে মাসিক মাত্র ৩শ’ টাকা সম্মানীতে নিয়োগ লাভ করেন। একইসাথে করতোয়া পত্রিকা ছাড়েননি কখনও। সেখানে কেটে যায় সাড়ে সাত বছর। এরপর ১৯৯৮ সালে ভোরের কাগজ ছেড়ে সম্পাদক মতিউর রহমান প্রথম আলো বের করলে সেখানে চলনবিল প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন মান্নান পলাশ। এসময় শুরুতে প্রথম আলোতে মাসিক ২ হাজার টাকা রিটেইনার ভাতা, সাথে লাইনেজ-ছবির বিল পেতেন। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে প্রথম আলো ছেড়ে অনলাইন পোর্টাল রাইজিংবিডিতে যোগ দেন চাটমোহর প্রতিনিধি হিসেবে। প্রথম আলো ছাড়ার সময় মাসিক ৫ হাজার রিটেইনার ভাতা সাথে লাইনেজ-ছবির বিল পেতেন তিনি। পরবর্তীতে রাইজিংবিডি ছাড়লেও করতোয়ায় কাজ করছেন আজ অবধি। এছাড়াও চাটমোহর থেকে প্রকাশিত দৈনিক চলনবিল পত্রিকায় নিয়মিত লেখা শুরু করেন ২০১৩ সাল থেকে। প্রতিদিন চলনবিল সমৃদ্ধ হয় তার লেখা দিয়ে।
পরিবার : স্ত্রীর নাম-খালেদা আক্তার, বড় মেয়ে পবিত্রা শারমিন কথা, ছেলে খালেদ মাহমুদ কাব্য। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ২০১৫ সালের মে মাসে। সে সরকারী এডওয়ার্ড কলেজে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স প্রথম বর্ষে ও ছেলে কাব্য রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে একাদশ শ্রেণীতে প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত।
প্রয়াত মোনাজাতের সাথে স্মৃতি ও পুরস্কার : দৈনিক সংবাদে মোনাজাত উদ্দিনের (সেই সময় উত্তরাঞ্জল প্রতিনিধি) তার গ্রাম সাংবাদিকতার রিপোর্ট পড়ে মুগ্ধ হতেন, আকর্ষণ তৈরী হয় পলাশের। তারপর ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় ঘটে তার শ্বশুর বাড়ি পাশের উপজেলা ফরিদপুরে হওয়ার কারণে। বিভিন্ন সময় মোনাজাতের সাথে দেখা সাক্ষাত হতো, শ্বশুড় বাড়িতে যাওয়ার সময় চাটমোহরে নেমে পলাশের সাথে দেখা করে যেতেন। গল্প আড্ডা দিতেন। বই প্রকাশ হলে পলাশের কাছে পাঠাতেন। তখন গ্রামীন সাংবাদিকতায় মোনাজাতের লেখা তাকে টানতো, তাই তার লেখাতেও উঠে আসতো গ্রামের সাধারণ মানুষদের কথা। মারা যাওয়ার পরে ২০০২ সালে কানসোনার গ্রামে গিয়ে তার লেখার ফলোআপ করে (যে গ্রামকে নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট করে ফিলিপস পুরস্কার পেয়েছিলেন মোনাজাত) ‘কেমন আছে মোনাজাতের কানসোনার মানুষেরা’ শিরোনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদন দৈনিক করতোয়া ও প্রথম আলোতে প্রকাশ হয় এবং সিরিজের শেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয় মোনাজাতের মৃত্যুদিবসে। এই সিরিজ প্রতিবেদন সেই সময় বগুড়া সাংবাদিক ইউনিয়ন ঘোষিত মোনাজাত স্মৃতি পুরস্কারে ১৬ জনের লেখা বাছাই করে প্রথম স্থান লাভ করেন মান্নান পলাশের সিরিজ রিপোর্ট। ৫ হাজার টাকা নগদ ও ক্রেস্ট-সনদপত্র লাভ করেন তিনি। এছাড়া দৈনিক করোতায়ায় বিভিন্ন সময় তিনবার শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক, সাংবাদিক তবিবুর রহমান পুরস্কার, চাটমোহর সবুজ সংঘের সবুজ পুরস্কার, জাসাস পুরস্কার সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। এর বাইরে প্রশিক্ষণ-বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটে (পিআইবি) পক্ষকালের সাংবাদিকতার উপরে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, আশা ইন্সটিটিউটে গ্রামীণ সাংবাদিকতার উপর তৃতীয় আবর্তনে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। প্রথম আলোর ইনহাউজ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন চারবার। তাড়াশ প্রেসক্লাবের উদ্যোগে তিনদিনের সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।
নতুনদের জন্য যা বললেন আব্দুল মান্নান পলাশ: দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতায় আব্দুল মান্নান পলাশ পেরিয়েছেন নানা চড়াই উৎরাই। সমৃদ্ধ হয়েছে অভিজ্ঞতার ভান্ডার। নতুনদের জন্য তার পরামর্শ জানতে চাইলে বলেন, তথ্য প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। ওই সময় সাংবাদকিতায় এমন অবস্থা ছিল না। আমরা শিখতে শিখতে সাংবাদিক হয়েছি। হাত ধরে আমাদের শিখিয়েছে অনেক প্রবীণ সাংবাদিক। সাংবাদিকতা যদি পেশা হিসেবে নিতে হয় তাহলে প্রক্রিয়ার মধ্যে সাংবাদিকতায় আসতে হবে। সংবাদ লেখা শিখতে হবে। জানতে হবে, বেশি পড়তে হবে। সংবাদের মুল সুত্রটা ঠিকই আছে। সেখান থেকেই শিখে জেনে আসতে হবে। কিন্তু সেই জানার জায়গাটা দুর্বল হয়ে আসছে। মুল ধারা ঠিক রেখে কাজ শিখে সাংবাদিকতা করতে হবে। সাংবাদিকতা কি ও কেন তা জানতে হবে। স্থানীয়রা সাংবাদিকতা থেকে সরে আসছে। শেখার, জানার আগ্রহ অনেকের নেই। যে অঙ্গীকার নিয়ে যে প্রত্যয়ে আমরা সাংবাদিকতায় আসছিলাম, সেই জায়গাটা মফস্বলে ঠিক নেই। যে কেউ রাতারাতি সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে। অনেকের দায়বদ্ধতা থাকলে সেই জায়গাটায় দায়িত্ব ঠিকমতো কেউ পালন করছে না। অনলাইন সাংবাদিকতাও এগিয়েছে, কিন্তু সেটা তথ্য নির্ভর অনেক সময় দুর্বল হয়ে যায়।
মান্নান পলাশ বলেন, আমরা যে প্রক্রিয়ার মধ্যে সাংবাদিকতা আসছি, সেই প্রক্রিয়া এখন ফলো করা হয় না। যে কারণে সংবাদের মান ও সংবাদ লেখার মান পড়ে যাচ্ছে। একজন সাংবাদিকের জন্য শেখার জায়গাটা যার যতো সমৃদ্ধ, সে ততো ভাল কাজ করবে। লেখার মানের উৎকর্ষ ঘটবে। পড়ার কোনো বিকল্প নাই। সংবাদ লেখায় সংবাদের তাৎক্ষনিকতা সর্ম্পকে ধারণা থাকতে হবে, আবহাওয়ার পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে, এগুলো না জানলে হবে না। বিবেকটা দাঁড়িয়ে থাকবে একটা সুতোর উপরে। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে কাজ করতে হবে। বিবেকে প্রশ্ন করতে হবে কোন পক্ষে কাজ করবে। নৈতিকতার বিষয়টি পরিস্কার থাকতে হবে, নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। সবসময় সত্যের পক্ষে, নির্যাতিতার পক্ষে সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। এই পেশাটি সম্পূর্নরুপে বিবেকাশ্রয়ী পেশা। যেহেতু আমরা দাবি করি সাংবাদিকতা পেশাটি মহান পেশা, সেহেতু অবশ্যই একজন সাংবাদিককে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থাকতে হবে। তা না হলে মহান শব্দটির কোনো অর্থ থাকবে না। এই ন্যায় ও সত্যের পক্ষে নৈতিকতা বোধ রেখে কাজ করলে সময় তাকে অবশ্যই মুল্যায়ন করবে।
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ||
৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ |
১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ |
২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ |
২৭ | ২৮ |
আইটি সাপোর্ট ও ম্যানেজমেন্টঃ Creators IT Bangladesh