বহু বছর আগের কথা। কাঞ্চিপুরের শেষ সীমানায় থাকতো মতি চোরা। তার নাম ডাক আর চুরির গল্প সাত গাঁয়ের মধ্যে সবসময় মানুষের মুখে মুখে ঘুরতো। কিন্তু কেউই কোনদিন তাকে দেখেনি। সবাই এর ওর কাছে গল্প শুনেছে মাত্র, কিংবা কোন ভাবে যারা ভুক্তভোগী, শুধু তারাই জানে মতি চোরা কি! হয়ত ভাবছেন, কেউ যখন মতি চোরাকে দেখেনি, তাহলে সেই যে চুরি করেছে তা নিশ্চিত হলো কিভাবে, তাই না?
হা হা হা। এই মতি চোরা ছিলো আর বাকি দশটা চোরের চেয়ে একদম আলাদা। ইদানীং আপনারা যে ধুম-২ হিন্দি সিনেমা দেখেন, সেই সিনেমায় হৃত্তিক যেমন চিহ্ন রেখে যেত, তেমনি মতি চোরারও একটা বিশেষ চিহ্ন ছিলো। সে যে বাড়িতে চুড়ি করত, সে বাড়ির দেয়ালে কিংবা অন্য কোন জায়গায় ‘মতিগতি’ কথাটা লিখে রাখতো। তাতে অবশ্য বুঝা যায়, মতি চোরা ছিলো শিক্ষিত এক চোর। আর তার চুরির শিকার হত গ্রামের বড় বড় সম্পদশালী লোকগুলাই।
মতি চোরা নিজের চুরির দক্ষতা নিয়ে মনে মনে বেশ গর্ব বোধ করতো। আর তাই সে তার চুরির পর সরাসরি নিজের নাম লিখে দিয়ে আসতো সদর্পে! অনেক পুলিশ, দাড়োয়ান, চৌকিদার দিয়েও তাকে ধরা যায়নি। আর ধরা যাবেই বা কি করে! তাকে যে কেউ কোনদিন দেখেই নি!! আর এই চোরের বাড়ি কই? কখন চুরি করে? কিভাবে করে তা বলা খুব মুশকিল।
যাই হোক, বেশ কয়েক বছরের তার নাম ডাক বেশ হয়েছে। সারা কাঞ্চিপুর, বৌভিটা, চুমিনগর আর ফতেহপুরের সকল লোক মতি চোরার চুরিতে অতিষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি তাকে ধরিয়ে দিতে কিংবা সন্ধান দিতে পারলে ২০,০০০ টাকা নগদ পুরস্কার ঘোষনা করেছে কয়েক গ্রামের চেয়ারম্যানরা। কিন্তু কিছুতেই তাকে ধরা যায় না!! বরং মতি চোরার চুরির ঘটনা দিনদিন বেড়েই চলছে, বৈ কমছে না।
এভাবে মতি চোরার পোয়া বারো, আর এলাকাবাসীর সর্বনাশ। কিন্তু কথায় আছে,‘‘চোরের দশ দিন আর গৃহস্তের একদিন। হলোও তাই।
তাহলে ঘটনাটা বলি, তখন মাঘ মাস চলছে। চারিদিকে কুয়াশা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার। মতি চোরা আজ বৌভিটার উত্তর সীমানায় ফেঞ্চুর বন নামে এক জঙ্গলে যাচ্ছে। ওখানে কয়েকদিন ধরে এক রাজাবাড়ির সন্ধান পেয়েছে সে! রাজ বাড়ি ঠিক রাজবাড়ি না। আসলে সেটা দেখলে মনে হবে যেন বনের মধ্যে কেউ অবকাশ যাপনের জন্য সুন্দর একটা প্রাসাদ তৈরি করে রেখেছে। প্রথম প্রথম এই বাড়িটা দেখে সে অবাকই হয়েছিলো। এমন একটা বাড়ি জঙ্গলের মধ্যে আছে,তা সে ভাবতেই অবাক!
আর সেদিনই তার চোরা মন এই রাজপ্রাসাদ চুরি করার জন্য অস্থির হয়ে আছে। আর তাই প্রায় সাতদিন ধরে সে এ বাড়ির উপর নজর রেখেছে। বাড়িতে খুব বেশি মানুষ যে থাকে না, তা এর নীরবতা দেখলেই বুঝা যায়। কিন্তু আশ্চার্যভাবে প্রাসাদের সামনের বাগান, ঘরগুলো এমনকি মেইন গেট থেকে ভেতরে ঢোকার রাস্তা টাও ঝকঝক করছে। তার মানে লোকজন তো থাকেই এখানে। কিন্তু কেন জানি কোন সারা শব্দ পাওয়া যায় না। কোথাও কোন পিন পতনের শব্দও নাই।
শুধু রাত্রে বেলা ঝিঝিপোকা আর দূরে কোথাও হতে খেঁকশিয়ালের ডাক শোনা যায় মাঝে মাঝে। আজকেও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু মতি চোরার কন্সেন্ট্রেশন এখন প্রাসাদের দিকে। গেটের বাইরের এক কড়ই গাছের উপর উঠে প্রাসাদের মানুষজনের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। দোতালার টানা বারান্দা দিয়ে দুইটা হারিকেন হাতে দু’জন মানুষ পুব দিক থেকে পশ্চিম দিকের একটা ঘরে ঢুকলো। তার কিছুক্ষন পর একজন বেড়িয়ে এসে নীচতলায় নেমে ঢুকলো প্রথম ঘরটায়।
কুয়াশা আর অন্ধকার হলেও এই কয়েক দিন ধরে প্রাসাদে নজর রাখায় এ সব কিছু সে সহজেই বুঝতে পারলো। কিন্তু সমস্যা হলো, এখনো মানুষ জেগে আছে। অতএব চুরি করার সময় এখনো আসেনি। আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।
গাছের ডালে বসে মশার সাথে অতি কষ্টে যুদ্ধ করে ঘন্টা দুই কেটে গেলো। ইতোমধ্যে যেসব ঘরে আলো জ্বলছিলো, তা নিভে গেছে। তাছাড়া কুয়াশাও বেড়ে গেছে। আর বাহিরে গাছের উপর বসে থাকতে থাকতে মতি চোরা ঠান্ডায় প্রায় জমে যাচ্ছিলো। কিন্তু যত যাই হোক, মতি চোরা সহজে হারবার পাত্র না। চুরি সে করবেই।
সে ধীরে ধীরে গাছ থেকে নীচে নেমে এলো। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে প্রাচীরের প্রধান ফটকে আসতেই মাথার উপর দিয়ে সাৎ করে একটা কিছু উড়ে গেলো। আকষ্মিক একটু ভয় পেলেও ঠিক পাত্তা দিলো না। তার সকল মনযোগ এখন প্রাসাদের ভিতরে ঢোকার। চারপাশে একটু দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে প্রাচীর সংলগ্ন একটা আমগাছের সাহায্যে প্রাচীর পার হলো। গেটের উপর দিয়েও পার হওয়া যেত, কিন্তু তার চেয়ে আম গাছটাই বেশি নিরাপদ মনে হলো তার কাছে। প্রাচীর পার হয়ে আবার হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো বুকে ভর দিয়ে প্রাসাদের পূর্ব পাশের সিড়িটার কাছে চলে এসেছে সে।
এবার সে পেছনে ফিরে একটু তাকালো, তারপর যা দেখলো তাতে তার চোখ চড়কগাছে!! মেইন গেট থেকে শুরু করে সারা বাগানের মধ্যে কোথাও কোথাও ক্ষীন আলো জ্বলছে। আর বেশ কয়েকজন পাইক-পেয়াদা তরবারি আর বল্লম হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন ঠিক আগেকার দিনের রাজা-বাদশাহদের রাজ প্রাসাদে যেভাবে সৈন্য সামন্ত পাহারা দিত, ঠিক তেমনিভাবে।
সে মনে মনে ভাবলো, কি ব্যাপার, এরা কোথা থেকে এলো ? দেয়াল পার হওয়ার সময়েও তো কেউ ছিলো না। এমনকি যখন সে বাগানের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আসছিলো তখনো তো কাউকে দেখা গেলো না। তাহলে?? হঠাৎ করেই যেন সাহসী মতি চোর ভয়ে চুপসে গেলো। গা-মাথা বেশ ভারী ভারী হয়ে এলো।
যে আশা নিয়ে চুরি করতে এসেছিলো তা ভয়ের সাথে মিশে রাজপ্রাসাদের সিড়িটার কাছে ঠকঠক করে কাঁপছে। কি করবে ঠিক মাথায় আসছে না। তার উপর শেয়াল গুলো আরো জোরে জোরে ডাকছে। মনে হচ্ছে খুব কাছে কোথাও। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে একটা চাপা কান্নার আওয়াজ কানে এলো। কেউ যেন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
কান্নার আওয়াজ শুনে তার ভয় কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কিন্তু কান্নাটা কোথা থেকে আসছে তা দেখার কৌতুহলে সে দুই একবার এদিক সেদিক তাকালো। কিন্তু ঠিক বুঝে ঊঠতে পারলো না।।
একটু সাহস নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলো। হ্যাঁ, আওয়াজটা এবার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। একটা মেয়েলী কান্না। কিন্তু কান্নার শব্দটা বেশ মায়াবী। ধীর পায়ে একটু একটু করে সামনে এগুচ্ছে সে। যতই সামনে এগুচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে কান্নার আওয়াজ।
কিন্তু একি?
এবার মনে হচ্ছে, একটি না, দু’টি কান্নার আওয়াজ। মতি চোরা একটু কানটা কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে চুলকে নিলো। নাহ, সে ঠিকই শুনেছে। দুইটা মেয়ে একসাথে কান্না করছে। একইভাবে। মতির গা ছমছম করে উঠলো। এবার সে দু’পা আগায় তো এক পা পিছায়। তারপর যে ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছে, সেই ঘরের সামনে চলে এলো।
ঘরের দরজাটা ভিরানো। দুই কপাটের মাঝের ফাঁক দিয়ে ভেতরটা বেশ দেখা যাচ্ছে। দু’জন বসে আছে। দুই জনই মেয়ে। দু’জনের সামনে একটা হারিকেন জ্বলছে মিটি মিটি। আর হারিকেন কে সামনে রেখে আশ্চর্য সুরে কান্না করছে দু’জন।
মতি চোরা সাবধানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সব। হঠাৎ একটা মেয়ে উঠে দাড়ালো, তারপর একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আবার নিজের আসনে বসল। এবার আরেকজনের হাতে বড় ছুরি হারিকেনের আলোতে ঝকঝক করে উঠলো। তারপর বাচ্চাটাকে মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে ছুরি দিয়ে গলা কেটে ফেললো ঐ মহিলাটা।
এসব দেখে মতি চোরা ভয়ে জড়োসর হয়ে জোরে করে এক চিৎকার দিয়ে পেছন দিকে দৌড়াতে শুরু করলো। যখন প্রায় সিঁড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে তখন দেখা গেলো মাথাহীন একটা ধর উপরে উঠে আসছে। তাই দেখে মতি চোরার প্রান যায় যায় ভাব।
এদিকে পেছন দিক থেকে ওই ডাইনি মহিলা দু’জন প্রায় কাছে এসে গেছে।
সামনে পেছনে কোথাও যাবার যায়গা নেই। ডাইনি মহিলা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। একজন আরেকজন কে বলছে, ‘‘আজ আরেকটা পেয়েছি। আজকের খাবারটা ভালোই হবে।’’
বলেই দু’জনে এক সাথে মতি চোরকে জাপটে ধরতে গেলো। আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো মতি চোরা।।
তারপর কি হয়েছে আর মনে নেই। যখন মতি চোরার জ্ঞান ফিরলো, তখন সে নিজেকে জঙ্গলের মধ্যে এক ফাঁকা জায়গায় আবিস্কার করলো। কোথায় সে প্রাসাদ? নাহ, কিচ্ছু নাই।
তারপর….
তারপর আর কোন দিন সে রাতের বেলায় বাইরে যেত না। চুরি তো দূরের কথা! হাফ ছেড়ে বাঁচলো এলাকাবাসী।
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | |
৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ |
১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ |
২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ |
২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |
আইটি সাপোর্ট ও ম্যানেজমেন্টঃ Creators IT Bangladesh
ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্টঃ WebNewsDesign